এই বইয়ের মূল কথা হচ্ছে, “তৈরি করুন-পর্যবেক্ষণ করুন-শিখুন”-যে কোন স্টার্টআপকে বড় করে তুলতে এই মডেল দারুণ কার্যকর।
একটি স্টার্টআপে প্রথমে থাকে একটি ভিশন। যারা এর পেছনে থাকেন তারা মনে করেন তাদের তৈরী পণ্যটি ভোক্তারা গ্রহন করবেন। এর ফলে তারা প্রচুর মুনাফা অর্জন করবেন। ব্যবসা বড় হবে, ইত্যাদি।
কিন্তু কেবলমাত্র এই ভিশনকে নিয়েই কাজ শুরু করা যায় না। একে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার দরকার আছে। বাস্তব জীবনের পরিবেশে পণ্যটি কীভাবে কাজ করবে, ভোক্তারা গ্রহন করবেন কি না ! ইত্যাদি। এরিক রাইসের একটি চমৎকার বই আছে এ বিষয়ে। বইটির নাম লিন স্টার্ট আপ। সেখানে তিনি একটি প্রক্রিয়ার কথা সবিস্তারে আলোচনা করেছেন।
সাধারণত যেভাবে বিস্তারিত ব্যবসা পরিকল্পণা আগে তৈরী করা হয় এবং অতঃপর কাজ করা হয়, এর থেকে একটু ব্যতিক্রম লিন স্টার্ট আপ পদ্বতি। এই পদ্বতিতে উদ্যোক্তারা তাদের ভিশনকে একটি নিয়মিত পরীক্ষা নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে নেন, সেইসব পরীক্ষা নিরীক্ষা থেকে জ্ঞান অর্জন করে মূল আইডিয়া বা পরিকল্পনায় দ্রুত গ্রহণ বর্জন করেন, এবং এভাবেই নিজেদের মানিয়ে নেন, ও তৈরি করেন একটি টেকসই ব্যবসা।
এই আইডিয়ার প্রবক্তা এরিক রাইস একজন আমেরিকান উদ্যোক্তা, লেখক ও ব্লগার। সিলিকন ভ্যালির সিরিয়াল অন্ট্র্যাপ্রেনার স্টিভ ব্ল্যাংক এ নিয়ে প্রচুর লেখালেখি করেছেন এবং একে জনপ্রিয় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। সোশ্যাল বিজনেসের জন্যও এই আইডিয়া অনুযায়ী ব্যবসা দাঁড় করানো যায়। নভোএড নামক অনলাইন শিক্ষামূলক ওয়েবসাইটে আকুমেনের এমন একটা কোর্সে আমি অংশ নিয়েছিলাম গত বছর।
লিন থিংকিং
লিন ইংরাজি শব্দটির বাংলা অর্থ রোগা-পাতলা বা কৃশতনু। লিন স্টার্ট আপ দিয়ে বুঝায় যে স্টার্ট আপে অপ্রয়োজনীয় কোন ব্যয়ই নেই। লিন থিংকিং কী?
সহজ কথায়, লিন থিংকিং হলো কাস্টমার বা ভোক্তাদের উপকার করছে বা তাদের কাছে যা ভ্যালু এড করছে সেসব ছাড়া বাকি সব কিছু অপচয় মনে করা।
ভ্যালিডেট লার্নিং বা আপনার জানাশোনাকে পরীক্ষা করা
বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান বলেছিলেন যে নিজেকে বোকা বানানোই সবচেয়ে সহজ, তাই এ ব্যাপারে আমাদের সবচেয়ে বেশী সাবধান থাকা উচিত। নিজেকে বোকা বানানোর জন্য মানুষের মধ্যে অনেক চিন্তার বায়াস কাজ করে। এর একটি হলো, কোন কাজে আমরা ব্যর্থ হলে নানা রকম যুক্তি হাজির করি, এমনভাবে যে মনে হয় ব্যর্থ হওয়াটাই বাস্তবতা ছিল এখানে। নিজেদের অক্ষমতা বা ভুলগুলি আমাদের চোখে পড়ে না।এরকম ঘটনা ঘটিয়ে ফেলার পর আলোচনা স্টার্ট আপের জন্য খুব খারাপ। কারণ তখন যত যুক্তিই দেয়া হোক না কেন, ক্ষতি যা হবার তা তো হয়েই গেছে।
আপনার যে ভিশন আছে তা হলো থিসিস। আপনি কাস্টমারদের কাছ থেকে যখন জানবেন তারা আপনার থিসিস গ্রহণ করবে কি না, বা তারা কী চায়; তখন আপনি আপনার থিসিসের বিপরীতেও অনেক আইডিয়া পেতে পারেন। কাস্টমারদের এই মতামতগুলিকে ধরেন নেন এন্টিথিসিস হিসেবে। থিসিস ও এন্টিথিসিসের সংঘর্ষ হয়, এবং এর ফলে উৎপন্ন হয় সিন্থেসিস। হেগেলিয়ান টার্ম যদিও, তথাপি লিন স্টার্ট আপের জন্য আপনার দরকার সিন্থেসিস।
নিজের ভিশন ও কাস্টমারদের মতামতের মিশ্রণে তৈরী এক নতুন জিনিস।
পরীক্ষা নিরীক্ষা যেভাবে করবেন
আপনি প্রথমে একটি হাইপোথিসিস ঠিক করলেন। এখানে দু’টি গুরুত্বপূর্ন অনুমান করেন উদ্যোক্তারা।
প্রথম অনুমান তাদের পণ্যটি কাস্টমাররা ব্যবহার করবেন। এটা করা হয় যাচাই করার জন্য তাদের পণ্যটি কাস্টমাররা কীভাবে গ্রহণ করবেন তা দেখতে।
দ্বিতীয় অনুমান কীভাবে তাদের কোম্পানিটির গ্রোথ হবে। এটা করা হয় যাচাই করতে কীভাবে নতুন কাস্টমাররা তাদের পণ্যটির ব্যাপারে জানবেন।
এই হাইপোথিসিস নির্ধারণ করতে কয়েকটি প্রশ্ন নিয়ে ভাবা দরকার।
প্রশ্ন-একঃ আপনি যে সমস্যার সমাধান করতে চেষ্টা করছেন ভোক্তারা সেই সমস্যাকে সমস্যা মনে করছে কি না বা তারা সমস্যাটির অস্তিত্ব সম্পর্কে জানে কি না।
প্রশ্ন-দুইঃ সমস্যাটির কোন সমাধান বের করা হলে তারা তা গ্রহণ করবে কি না?
প্রশ্ন-তিনঃ তারা আমাদের কাছ থেকে এই সমাধান কিনবে কি না?
প্রশ্ন-চারঃ আমরা কি ঐ সমস্যাটির একটি সমাধান বানাতে পারব?
এখানে মনে রাখতে হবে সফলতা এটা নয় যে একটা ফিচার দেয়া কাস্টমারদের। আপনাকে কাস্টমারদের সমস্যার সমাধান করতে হবে। এই সমাধান করা শেখাটাই হলো সফলতা।
ফিডব্যাক লুপ
প্রথমে আইডিয়া, তারপরে উদ্যোক্তা তৈরী করা শুরু করলেন একটি স্যাম্পল বা মিনিমাল ভায়াবল প্রোডাক্ট। তৈরী হলে তিনি তা নিয়ে যান কাস্টমারদের কাছে। তাদের মতামত পর্যবেক্ষণ করেন। মতামতের ডাটা সংগ্রহ করেন। এর উপর ভিত্তি তিনি শেখেন, আবার মূল আইডিয়ায় ফিরে যান ও পরিবর্তন দরকার হলে পরিবর্তন করেন। এই চক্রটির নাম ফিডব্যাক লুপ।
এই ফিডব্যাক লুপে যেন সময় কম লাগে সে ব্যাপারে উদ্যোক্তাদের সচেতন থাকতে হবে। এখানে কোন একটা স্তরে অধিক সময় বের করা যাবে না। সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই। যত দ্রুত পারা যায় সমস্ত প্রক্রিয়াটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
প্রাথমিক পণ্য বা মিনিমাল ভায়াবল প্রোডাক্ট কী এখানে?
মূল পণ্যের প্রাথমিক এক রূপ যা স্বল্পতম সময়ে ও স্বল্প খরচে তৈরী করা হয় কাস্টমারদের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য। প্রাথমিক পণ্য তৈরী করার আগে উদ্যোক্তাদের নিজের আইডিয়া বা ভিশনটি সম্পর্কে মোটামোটি নিশ্চিত হতে হয়।অর্থাৎ, মার্কেট এনালাইসিস আগে হয়। এরপরই তারা প্রাথমিক পণ্য নির্মানে যান। এই নির্মানের প্রক্রিয়া শুরুর সাথে সাথে ফিডব্যাক লুপ শুরু হয়ে যায়।
প্রাথমিক পণ্য একেবারে ফালতু হলে চলবে না। যে পণ্যটির পরিকল্পনা করেছেন উদ্যোক্তারা তার মোটামোটি দরকারী ফিচার এই পন্যটিতে থাকবে, অদরকারীগুলি থাকবে না। তাই তৈরি হবে সম্ভব স্বল্পতম খরচে।
এটি ব্যবহার করবেন প্রাথমিক কাস্টমারেরা। এর উদ্দেশ্যঃ
স্বল্পতম রিসোর্সের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের হাইপোথিসিস পরীক্ষা করা।
শেখার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা।
অপ্রয়োজনে অতিরিক্ত পরিশ্রম এড়ানো। কারণ প্রাথমিক পণ্য থেকে সরাসরি জানা যাবে কাস্টমার কী চায় ও কী চায় না। তখন মূল পণ্য বানাতে ঐগুলিতেই লক্ষ দিলে চলবে।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাস্টমারদের কাছে পণ্য নিয়ে যাওয়া।
অন্য পণ্যের এর এই পণ্য ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। এই ভিত্তির উপরই নির্মিত হবে পরবর্তী ভার্সন বা মূল পন্য।
এই প্রাথমিক পণ্য ম্যাস মার্কেট তথা সর্ব সাধারণের জন্য উন্মুক্ত না হয়ে যেতে পারে বিশেষ এক ধরণের কাস্টমারদের কাছে, যারা পণ্যের ভবিষ্যত উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। এটা কেবল প্রযুক্তিগত বিজনেস বা স্টার্ট আপের জন্য বেশী প্রযোজ্য। এই ধরণের কাস্টমারদের বলা হয় আর্লি এডপটারস। এরা পারফেক্ট প্রোডাক্টের চাইতে প্রথম ব্যবহারকারী হতে আগ্রহী। প্রোডাক্টের কী কী উন্নতি দরকার এ বিষয়ে মতামত রাখতে পারদর্শী।
---------------------------------------------------------------------------------------------
Video Summary: Video Book Summary
No comments:
Post a Comment