উদ্যম, বিনিয়োগ আর উদ্ভাবনে মনকে উদার করো,
একটি গুগল পাওয়ার তরে হাজার গুগল গড়ো।
ইন্টারনেট ব্যবহার করে কিন্তু গুগলের নাম শোনেনি, এমন মানুষ সম্ভবত খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ইন্টারনেট সার্চ ইঞ্জিন (যেখান থেকে ইন্টারনেটে প্রাপ্য তথ্যের ঠিকানা বের করা যায়) গুগলের আগেও ছিল, তবে গুগলই প্রথম ব্যাপারটিতে সাংস্কৃতিক মাত্রা যোগ করেছে। সার্চ ইঞ্জিনের ব্যাপার এখন ইন্টারনেট-সংস্কৃতির মূল অনুষঙ্গ। ‘গুগল করো’, ‘গুগলে গিয়ে দেখে নিয়ো’ ইত্যাদি এখন খুবই সাধারণ কথা। ইংরেজিতে এমনকি ‘গুগলাইজেশন’ নামে একটি নতুন শব্দ গুগলের সর্বগ্রাসী রূপকে প্রকাশ করে। বলা হয়ে থাকে বর্তমানে ৭০ শতাংশেরও বেশি ওয়েবসাইটে লোকজন গুগল তথা সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে যায়! সাদামাটা দেখতে গুগলের প্রথম পাতাটিতে এর ব্যবসায়িক ব্যাপারটি সহজে দেখা যায় না, যদিও গুগল একটি মাল্টি বিলিয়ন কোম্পানি।
আইটি ক্ষেত্রের সূতিকাগার আমেরিকার সিলিকন ভ্যালির বিকাশের পেছনে সবচেয়ে বড় উপাদান স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভাবনের চর্চা, উদ্যমী প্রযুক্তিবিদ ও প্রকৌশলীদের ‘আইডিয়ার পেছনে’ উদ্যমী বিনিয়োগকারীদের (ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট) অবস্থান এবং হাজার হাজার ‘সাকসেসফুলি ফেইলিউরের কেস’।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একজন শিক্ষার্থীর মানসপট তৈরি হয়। তার চিন্তাচেতনা এবং ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের একটি স্বপ্নও সে এই সময় বোনে। নতুন কিছু গড়ে তোলার একটি আকাঙ্ক্ষাও হয় তীব্র। সিলিকন ভ্যালি তাদের সেই স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষাকে মূল্য দেয়। স্বপ্ন নির্মাণ ও বাস্তবায়নে দরকার সুযোগ এবং অর্থ। সিলিকন ভ্যালিতে রয়েছে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি, যারা অর্থ নিয়ে দাঁড়ায় নতুন স্বপ্নচারীদের পাশে। আছে ব্যক্তি উদ্যমী বিনিয়োগকারীরা, যারা স্বপ্নের পেছনে অর্থ বিনিয়োগে পিছপা হয় না।
একজন শিক্ষার্থী বা শিক্ষার্থীদের একটি গ্রুপ হয়তো কাজ করছে কোনো নতুন ধারণা নিয়ে, সেটির পেছনের বিজ্ঞান আর ব্যবসাটাকে সাজাতে। দুটো জিনিসই দরকার। প্রথমত নতুন ভাবনাটি যে ফেলনা নয়, সেটি প্রমাণ করা। এ জন্য তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে নানা চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়। কখনো কখনো তারা খুঁজে পায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এলামনাই, যারা কাজ করছে বিভিন্ন কোম্পানিতে। এরপর সেটির ব্যবসায়িক দিকটি ভাবতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসার কাজে কেউ দাতব্য প্রতিষ্ঠান খোলে না। কাজেই বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে ব্যবসায়িক মডেলটা ভালোভাবেই তৈরি করতে হয়। তারপর শুরু হয় বিনিয়োগকারী খোঁজার পালা। যেসব চিন্তা-ভাবনা, মডেল কাগজ আর কম্পিউটারে ছিল, সেগুলো বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা। কেউ সফল হয়, কেউ হয় না!
গুগলের গল্পটাই বলা যাক। ১৯৯৬ সালে ল্যারি পেজ আর সের্গেই ব্রিন স্ট্যানফোর্ডে তাদের পিএইচডি রিসার্চ হিসেবে ওয়েবে একটি নতুন অনুসন্ধানী এলগারিদম(ইন্টারনেটে তথ্য অনুসন্ধান নতুন একটি পথ) নিয়ে কাজ শুরু করে, সেই সময়কার সার্চ ইঞ্জিনগুলোর প্রচলিত পথ থেকে সরে এসে তারা ওয়েবপাতাগুলোকে একটি র্যাংকিংয়ের আওতায় নিয়ে আসে। পেজ আর ব্রিন তাদের মডেল সার্চ ইঞ্জিনের নাম দেয় ব্যাকরাব (Backrub)। তবে, পরে তারা গুগল (Google) শব্দটি বেছে নেয়। গুগল হলো ১-এর পর ১০০টি শূন্য দিলে যে সংখ্যাটি হয়, সেটি। সার্চ ইঞ্জিনটি কত বেশি তথ্য খুঁজবে, সেটা বোঝাতে এই শব্দটি নেওয়া হয়। শুরুতে এর ঠিকানা ছিল google.stanford.edu। পরে ১৯৯৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর এটি হয় google.com। ১৯৯৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর এক বন্ধুর গাড়ির গ্যারেজে, ক্যালিফোর্নিয়ার মেনলো পার্কে গুগলের যাত্রা শুরু। দুই বন্ধুর টাকা ছাড়াও এই সময় তাদের পাশে দাঁড়ান সান মাইক্রোসিস্টেমের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এন্ডি বেথটোশেইম। কোম্পানি হওয়ার আগেই তিনি পেজ আর ব্রিনকে এক লাখ ডলার দেন। পরের বছর জুন মাসে দুটি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি গুগলে আড়াই কোটি (২৫ মিলিয়ন) ডলার বিনিয়োগ করে। আর ২০০৪ সালে ৮৫ ডলারে গুগল শেয়ারবাজারে তাদের শেয়ার ছেড়ে দুই হাজার ৩০০ কোটি ডলার জোগাড় করে! বিনিয়োগকারীরা যে ভুল করেনি, তার প্রমাণ হলো, মাত্র তিন বছরের মাথায় এর প্রতিটি শেয়ারের মূল্য দাঁড়ায় ৭০০ ডলারে!
যে সময়ে গুগলের এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা পায়, সে সময় কমপক্ষে কয়েক হাজার অনুরূপ উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। একটি সাধারণ হিসাবে বলা হয়ে থাকে, গড়পড়তা একটি সফল গুগল পাওয়ার জন্য কমপক্ষে আড়াই হাজার উদ্যোগের প্রয়োজন!
কাজেই, সফল উদ্যোক্তা আর সফল উদ্যোগ পেতে হলে আমাদের চেষ্টাবান হাজার হাজার উদ্যোক্তা প্রয়োজন হবে। ব্যর্থ উদ্যোক্তাদের প্রতি ভ্রু কুঁচকে তাকালে হবে না, তাদের নতুন উদ্যমে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় আর সমাজের দায়িত্ব এখানে সুবিশাল। আমরা কেবল সফল গল্প খুঁজি। কিন্তু প্রতিটি সফল গল্প হওয়ার জন্য যে হাজারখানেক ‘সাকসেসফুলি ফেইলিওর’ কেস থাকা দরকার, সেটা বিশ্বাস করি না!
একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য এই ধারাটি আমাদের ভাঙতে হবে। আমাদের তরুণদের উদ্যমী, আত্মবিশ্বাসী এবং সফল হওয়ার জন্য তাদের বেশি বেশি সুযোগ দিতে হবে। তাদের অনেকে ব্যর্থ হবে, কিন্তু সুযোগ থাকলে তারা ঘুরে দাঁড়াবে। তাদের জন্য আমাদের এই কাজগুলো করতেই হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এগিয়ে আসতে হবে, যাতে তাদের শিক্ষার্থীরা নতুন চিন্তা করে, নতুন উদ্যম খুঁজে বেড়ায়। দৃষ্টান্ত তৈরির মতো বুয়েটের অধ্যাপক লুৎফুল কবীর স্যারের প্রি-পেইড মিটারকে গবেষণাগার থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদনে নিয়ে আসার যন্ত্রণা পোহাতে হবে। অন্যদিকে সমাজের বিত্তবান বিনিয়োগকারীদের এগিয়ে আসতে হবে নতুন নতুন ধারণাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে। ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদেরও এই দিকে নজর দিতে হবে।
আর সরকার? সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কাজটা করবে, পথের বাধা সরিয়ে নেবে। যৌথ বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তা দেবে, অভয় দেবে। দেশীয় উদ্যোগ যাতে বিদেশি জাত পণ্যের সঙ্গে লড়তে পারে তার ব্যবস্থা নেবে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ইনকিউবেটর, উদ্যোক্তা পরিচর্চাকেন্দ্র গড়ে তুলতে সহায়তা করবে।
আর সরকার? সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কাজটা করবে, পথের বাধা সরিয়ে নেবে। যৌথ বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তা দেবে, অভয় দেবে। দেশীয় উদ্যোগ যাতে বিদেশি জাত পণ্যের সঙ্গে লড়তে পারে তার ব্যবস্থা নেবে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ইনকিউবেটর, উদ্যোক্তা পরিচর্চাকেন্দ্র গড়ে তুলতে সহায়তা করবে।
কাজগুলো কঠিন নয়, আমাদের সবাইকে এখন থেকেই যার যার কাজ শুরু করতে হবে।
মুনির হাসান: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি।
No comments:
Post a Comment